বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত একটি ব্যবসা পদ্ধতির নাম হচ্ছে এম. এল. এম. (MLM)। স্বল্প সময়ে অধিক আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে লাখো মানুষ।...
মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং ( MLM ), যাকে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা পিরামিড বিক্রিও বলা হয় , এটি একটি বিতর্কিত এবং কখনও কখনও পণ্য বা পরিষেবার বিক্রয়ের জন্য অবৈধ বিপণন কৌশল যেখানে MLM কোম্পানির রাজস্ব একটি অ-বেতনপ্রাপ্ত কোম্পানির পণ্য বিক্রি করার সময় কোম্পানির পণ্য বিক্রির অংশ বা কর্মচারীদের উপার্জন করা হয়।
MLM-এর পূর্ণরূপ Multi Level Marketing। এটি একটি ধাপে ধাপে ছড়িয়ে পড়া ব্যবসায়িক পদ্ধতি
MLM ব্যবস্থায় আপনি শুধু নিজে পণ্য বিক্রি করেই নয়, অন্যদের এই ব্যবসায় যুক্ত করলে (আপনার অধীনে "ডাউনলাইন" হিসেবে) তাদের বিক্রি থেকেও আপনি কমিশন পান। এভাবে একটি বহুমাত্রিক (multi-level) বিক্রয় নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে।
ইসলামে ব্যবসা হালাল, কিন্তু তার কিছু স্পষ্ট শর্ত আছে। যেমন প্রতারণা থাকবে না, সুদ থাকবে না ইত্যাদি।
হাটহাজারী দারুল উলুমের প্রখ্যাত ওলামায়ে কেরাম MLM নিষিদ্ধ বলেছেন...
এম, এল, এম, বর্তমান সময়ে সর্বাধিক আলােচিত অন্যতম ব্যবসা পদ্ধতি। ১৯৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম এর উদ্ভব ঘটে আমেরিকায়। অল্প সময়ে তা ছড়িয়ে পড়ে গােটা বিশ্বে। একপর্যায়ে ৯০ এর দশকে এর অনুপ্রবেশ ঘটে বাংলাদেশেও। মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এর শাখা প্রশাখা। সাধারণ জনগণের
পাশাপাশি বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমানও যুক্ত হয় এ ব্যবসায়। তবে এর বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতনদের মনে নানাবিধ সংশয়ের দানা বাঁধে। এ সংশয় নিরসনে তারা ওলামায়ে কেরামের শরণাপন্ন হন। জানতে চান এর শরয়ী বিধান। ওলামায়ে কেরামও সাধ্যমত এর
সমাধান দিয়ে আসছেন। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে এ বিষয়ে কিছু আলােচনা তুলে ধরা হলাে।
এম, এল, এম, এর পরিচিতি-what is MLM
এম, এল, এম, বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং একটি ব্যবসা প্রক্রিয়া, যা বহুমূখী দালালীর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যাকে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং, ডাইরেক্ট সেলিং ও রেফারাল মার্কেটিংও বলা হয়।
এ সকল কোম্পানির মূল কাজ হলাে:
১. বিনা পুঁজিতে ব্যবসার একটি কৌশল অবলম্বন
করা।
২. বিজ্ঞাপন ব্যয় ছাড়াই কোম্পানির পণ্য বাজারজাত করার একটি পদ্ধতি অবলম্বন
করা।
৩. ডিস্ট্রিবিউটরের (পরিবেশক) মাধ্যমে বিনা বিজ্ঞাপনে সহজেই সারা দেশে পণ্য
ছড়িয়ে দেয়া।
৪.ডিস্ট্রিবিউটর, এজেন্ট ও সরবরাহের ঝামেলা অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে কৌশলে বিপুল পরিমাণ লাভবান হওয়া৷
বিক্রয় বিপণন, তথ্যবিনিময়ের মাধ্যমে নতুন ক্রেতা সৃষ্টি করা, নতুন নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র
তৈরী করা ব্যবসায়িক কার্যক্রমের এক অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, ব্যবসার কাজ
হলাে পণদ্রব্য ও সেবা সামগ্রী ভােক্তাদের হাতে পৌছানাে। তাই উৎপাদকগণ তাদের সেবা
সামগ্রী ভােক্তাদের হাতে পৌছাতে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। মাল্টিলেভেল।
মার্কেটিং তারই একটি রূপ, একথাই বলতে চায় এম, এল, এম, কোম্পানিগুলাে।
এম, এল, এম, এর কার্যক্রম
এম, এল, এম. এর শরয়ী বিধান জানতে হলে, প্রথমে প্রয়ােজন এর নীতি ও কর্মপদ্ধতি
জানা। তাই নিম্নে এর ফরম ও প্রচারিত বই-পুস্তকলব্ধ কিছু নমুনা তুলে ধরা হলাে।
১. এম, এল, এম, কোম্পানিগুলাে সারা দেশে পণ্য বিক্রয়ের জন্য ডিস্ট্রিবিউটর বা
পরিবেশক তৈরি করে থাকে। তবে পণ্য বিক্রয়ের তুলনায় পরিবেশক তৈরি করা বা পণ্য
ক্রয়ের চেয়ে পরিবেশক হওয়াটাই মূখ্য হয়ে থাকে। যে কারণেই স্বল্পমূল্যের পণ্য কয়েক
গুণ বেশি মূল্য দিয়ে সংশয়হীনভাবে ক্রয় করে থাকে।
২. এ সকল কোম্পানিগুলােতে পরিবেশক হতে হলে তাদের নির্ধারিত মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে
হয়।
৩. কোনাে ব্যক্তি কোম্পানির পরিবেশক হওয়ার পর যদি কোনাে নতুন ব্যক্তিকে কোম্পানির
নিয়মে ক্রেতা ও পরিবেশক বানায় তাহলে এর বিনিময়ে সে ব্যক্তি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা
কমিশনের নামে পেয়ে থাকে। আর এভাবে ডাউন লাইন যতই বাড়তে থাকবে তার
কমিশনও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকবে, যদিও সে নিজে কোনাে
কাজ না করে। অর্থাৎ তার কমিশন প্রাপ্তি ডাউন লাইনের শ্রমের সাথে শর্তযুক্ত। ফলে
যথাসাধ্য শ্রম দেয়ার পরও নির্দিষ্ট পরিমাণ নতুন পরিবেশক বানাতে না পারলে প্রথম ব্যক্তি
কোনাে পারিশ্রমিক বা কমিশন পাবে না।
৪. এছাড়াও কিছু কিছু এম, এল, এম, কোম্পানিতে টাকা বিনিয়ােগের ব্যবস্থা আছে। এ
সকল কোম্পানিতে টাকা বিনিয়ােগ পদ্ধতি হলাে, কোনাে ব্যক্তি এ সকল কোম্পানিতে নির্দিষ্ট
পরিমাণ টাকা বিনিয়ােগ করলে কোনাে প্রকার ঝুঁকি গ্রহণ করা ছাড়াই তাকে নির্দিষ্ট সময়ের
পর পূর্ব নির্ধারিত হারে লাভ দেয়া হয়।
৫. এমনিভাবে কিছু এম, এল, এম, কোম্পানি। যেমন, ডেসটিনি ২০০০ লি: বৃক্ষায়নে
বিনিয়ােগ করে থাকে। আর তাদের বৃক্ষায়ণের বিনিয়ােগ পদ্ধতি নিম্নরূপ-
যদি কোনাে ব্যক্তি ৬/১২ বছরের জন্য ৩০টি গাছ ক্রয় বাবদ ১০,০০০/= টাকা বিনিয়ােগ
করে তাহলে তাকে (বিনিয়ােগকারীকে) একটি মালিকানা সনদপত্র দেয়া হয়। অতঃপর,
৬/১২ বছর পর কোনাে রকম ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়া ছাড়াই ২৫/৫০ হাজার টাকা তাকে
ফেরত দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, বিনিয়ােগকারীকে চুক্তির সময় গাছ দেখানাে হয় না। এম, এল,এম, এর বিনিয়ােগ
পদ্ধতিতেও রয়েছে মাল্টিলেভেল সিস্টেম অর্থাৎ এখানে কেউ বিনিয়ােগ করতে চাইলে তাকে
অবশ্যই ডিস্ট্রিবিউটর ধরে আসতে হবে এবং বিনিয়ােগ করার পর সেও ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে
যাবে। এরপর তার নিচে যারা বিনিয়ােগ করবে তাদের থেকে সেও একটা কমিশন পেতে
থাকবে। উল্লেখ্য, এ প্রবন্ধে এম. এল. এম. এর নীতি ও কার্যক্রম থেকে শরী'আতের দৃষ্টিতে
আপত্তিকর কিছু দিক তুলে ধরা হলাে।
এম, এল, এম, কোম্পানির শরীআত নিষিদ্ধ বিষয়াবলী শরী'আত মু'আমালাতের ক্ষেত্রে বহু বিষয়কে নিষিদ্ধ করেছে। যার মধ্য হতে কিছু বিষয়
এম, এল, এম, ব্যবসা পদ্ধতিতে পাওয়া যায়।
যেমন-
১. এক চুক্তির মধ্যে অন্য চুক্তির শর্ত করা ৷
২. চুক্তিকে শর্তের সাথে ঝুলন্ত রাখা ।
৩. ধোকা ও অনিশ্চয়তা ৷
৪. বিনিময়হীন শ্রম ৷
৫. শ্রমহীন বিনিময় ৷
৬. সুদ ইত্যাদি ।
বিস্তারিত দেখুন দরসূল ফিকহ৷ পৃষ্টা: ৩০৫-৩১৩
সারকথা:
এম.এল.এম, এর কার্যক্রম পর্যব্বেণ, তাদের নিয়ম-পদ্ধতির বিশ্লেষণ ও এ সকল
প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অভিমতের আলােকে জানা যায় যে, এ ব্যবসা পদ্ধতিতে
উল্লিখিত নিষিদ্ধ বিষয়গুলাে ছাড়াও আরােও কিছু শরী'আত নিষিদ্ধ বিষয় রয়েছে। সুতরাং
কোনাে মুসলমানের জন্য এ সকল কোম্পানির সাথে কোনােভাবে সম্পৃক্ত হওয়া জায়েয।
বৈধ হবে না। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত ঈমানী দাবিতে এম. এল. এম. বর্জন করা।
আল্লাহ তা'আলা সকল মুসলমানকে এম, এল, এম, সহ সকল প্রকার নাজায়েয লেনদেন।
থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন!
সত্যায়নে:
মুফতী নূর আহমদ হাফিযাহুল্লাহ
প্রধান মুফতী ও মুহাদ্দিস দারুল উলুম
হাটহাজারী ৷
মুফতী আব্দুস সালাম চাটগামী হাফিযাহুল্লাহ
মুফতী আযম ও মুহাদ্দিস, দারুল উলুম হাটহাজারী
৩০ জুমাদাল উখরা ১৪৩৫হি,
মুফতী জসীমুদ্দীন হাফিযাহুল্লাহ
মুফতি ও মুহাদ্দিস দারুল উলুম হাটহাজারী
০৪ জুমাদাল উলা ১৩৫হি,